|| সারাবেলা প্রতিবেদক||
রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জ্বালানির প্রথম চালানটি আসছে ভারত থেকে। পয়লা জুলাই বৃহস্পতিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত খবরে এমনটাই জানানো হয়েছে। পত্রিকাটির “ইন্দো-বাংলা পাওয়ার প্রজেক্ট সেট টু গেট ফার্স্ট কনসাইনমেন্ট অব ফুয়েল ফ্রম কলকাতা পোর্ট: অফিসিয়াল” শিরোনামের খবরটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশেন এনপিটিসি লি. এর যৌথ বিনিয়োগে নির্মানাধীন একটি তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য কয়লাজ্বালানির প্রথম চালানটি কলকাতা বন্দরে নোঙর করেছে। এবং চালানটি আগামি দুই থেকে তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মোংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। দেশটির সংশ্লিষ্ট একজন সরকারি কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি (সাবেক কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট) বন্দরের ডেপুটি চেয়ারম্যান এক কে মেহরা ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া পিটিআইকে জানান, ‘ধানবাদ থেকে কয়লার প্রথম রেকটি কলকাতা এসে পৌঁছেছে এবং এগুলো এখন খালাস করা হচ্ছে। আগামী দু থেকে তিন দিনের মধ্যে এগুলো রামপাল পাওয়ার প্লান্টের জন্য মোংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে জাহাজিকরণ করা হবে।’

এই রেকটিকে প্রথম চালান জানিয়ে মেহরা বলেন, ‘প্রতিটি রেকে প্রায় তিন হাজার আটশ’ টন কয়লা রয়েছে। এবং কলকাতা বন্দর থেকে এটিই হবে রামপালের জন্য কয়লার প্রথম রফতানি।’
এই বিদ্যুতকেন্দ্রটি পুরোদমে চালু হলে শুধু এই কলকাতা বন্দর দিয়েই প্রতিমাসে ২০ হাজার টন কয়লা মোংলা বন্দরে যাবে।
ভারত থেকে আনা কয়লাকে নিকৃষ্ট মানের জানিয়ে বাংলাদেশের তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘সুন্দরবন বিনাশী রামপাল প্রকল্প যে প্রথম থেকেই মিথ্যাচার, অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, প্রতারণা এবং জবরদস্তির ওপর চলছে তার সর্বশেষ নমুনা এটি। বাংলাদেশের নয় ভারতের পত্রিকার খবর- সুন্দরবনে কয়লা পোড়ানোর জন্য কলকাতা বন্দর দিয়ে আনা হচ্ছে ভারতের নিকৃষ্ট কয়লা। অথচ সবসময়ই সরকার থেকে দাবি করা হয়েছে- ভারত থেকে কয়লা আনা হবে না, এখানে ব্যবহার হবে উচ্চ প্রযুক্তি এবং পৃথিবীর ‘সর্বোত্তম মানের কয়লা’।



তিনি তার স্ট্যাটাসে এও লেখেন, ‘আমরা বরাবর এসব কথার অসারতা সম্পর্কে সবার দৃষ্টি করতে চেষ্টা করেছি। এখন বাস্তবে আনা হচ্ছে ভারতেরই নিকৃষ্টতম কয়লা। বরাবরই বলেছি এই প্রকল্পে মুনাফা করবে ভারতের এনটিপিসি, নির্মাণ কাজে ভেল ইন্ডিয়া, ঋণের ব্যবসা করবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক এবং কয়লার ব্যবসা করবে কোল ইন্ডিয়া আর তাদের সহযোগী বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপ। এটিসহ বিভিন্ন কয়লা প্রকল্পে ব্যবসা করবে জার্মানি, জাপান, চীনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশের লুটেরা কিছু গোষ্ঠী। সর্বনাশ হবে বাংলাদেশের, আর সীমান্তের দুপারেরই সুন্দরবনের। লকডাউন-শাটডাউনে যখন বহুকাজ বন্ধ তখন দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠীকে খুশি করতে জোরকদমে এসব ধ্বংসযজ্ঞ আর জবরদস্তি চালাতে, অপরাধের তালিকা বাড়াতে সরকার বেপরোয়া!’
উল্লেখ্য, ভারতের এনটিপিসি লি. ও বাংলাদেশের বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি বিআইএফপিসি।
এরআগে পরিবেশবাদীদের এমন আপত্তি ও বিরোধিতার জবাবে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে ভারত সফরসময়ে বাংলাদেশ সরকার প্রধানের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেন যে রামপালে পরিবেশগত আশঙ্কার দিকটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।



কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কারণে রামপাল প্রকল্প পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং নিকটবর্তী সুন্দরবনে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনবে – পরিবেশবাদীদের এই যুক্তি আবারো নাকচ করে তিনি বলেন, ‘আমরা রামপালে যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছি এবং যেসব দূষণবিরোধী পদক্ষেপ বা মিটিগেটিং মেজারস নিচ্ছি তাতে সুন্দরবনের বা পরিবেশের কোনও বড় ঝুঁকি আর নেই।’
তিনি আরও জানান, রামপালে অনেক খরচ করে বাংলাদেশ এখানে যে ‘আলট্রা-সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তি’র প্রয়োগ করছে, তাতে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেসকো পর্যন্ত সন্তষ্ট।
রামপাল নিয়ে পরিবেশবাদীদের আপত্তির একটা বড় কারণ ছিল ওই প্রকল্পে কয়লা ব্যবহার করা হচ্ছে – যা প্রবল দূষণ সৃষ্টিকারী জ্বালানি হিসেবে পরিচিত।
মি. চৌধুরী অবশ্য দাবি করছেন, তারা এখন যে ধরনের প্রযুক্তি রামপালে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে কয়লা সুন্দরবনের কোনও ক্ষতি করবে না। তিনি বলেন, ‘কয়লা নিয়ে আশঙ্কার প্রধান কারণটা হল বাতাসে তারা সালফার অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইড – যাদের সংক্ষেপে ‘সক্স নক্স’ বলা হয়ে থাকে – তার নির্গমন ঘটায়। এগুলো থেকে আবার অ্যাসিড রেইন-ও হয়।’ অ্যাসিড বৃষ্টি সম্পর্কে প্রধানন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, ‘কিন্তু আমরা রামপালে আলট্রা সুপার-ক্রিটিকাল বা বিশেষ ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর ফলে এই সালফার বা নাইট্রাস পার্টিকলগুলোকে ট্র্যাপ করে ফেলা সম্ভব – অর্থাৎ বাতাসে সেগুলো বেরোতেই পারবে না।’
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘এতে আমাদের অনেক বাড়তি খরচ হচ্ছে ঠিকই, প্রকল্পের ব্যয়ও হয়তো কিছুটা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সব আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে রামপালে বলা যেতে পারে একেবারে ‘ক্লিন কোল’ টেকনোলজি বা প্রায় সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত কয়লার ব্যবহার হচ্ছে।’
এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী পাওয়ার কোম্পানির কয়লাভিত্তিক মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্টটির নির্মান কাজ ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে নির্মানসময় একবছর বাড়ানো হয়েছে।


