|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
সারাদেশে শিল্প কল কারখানা, শপিংমল হাটবাজারের মতো জনসমাবেশপ্রবণ প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকলেও গেলো একমাসের বেশী সময় ধরে বন্ধ রয়েছে আন্তজেলা গণপরিবহন তথা দূরপাল্লার যাত্রীবাহন। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার তত্ত্বাবধায়ক স্বাস্থ্যমন্ত্রী চাইছেন গণপরিবহন আরো কিছুদিন বন্ধ থাকুক। আর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, যেসব মানুষ ঈদ করতে ঢাকাসহ বড় শহরগুলো ছেড়ে গেছেন তাদের ফিরতে অন্তত ১০দিন লাগবে। তাই ‘কঠোর লকডাউন’ এর মেয়াদ আগামী ২৩শে মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এদিকে আর্থিক সংকটে বিপর্যস্ত পরিবহন শ্রমিকরা দূরপাল্লার যাত্রীবাহন খুলে দেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করছেন দেশের বিভিন্ন শহরে। দুরপাল্লার যাত্রীবাহন চালুর দাবি জানিয়ে শ্রমিকদের অনুদান-বেতন-বোনাস ও যানবাহন মেরামতের জন্য সহজ শর্তে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ চেয়েছেন পরিবহন শ্রমিক নেতা মালিক ও সংসদ সদস্য শাজাহান খান।
দূরপাল্লার বাহন বন্ধের পক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী
মালিক-শ্রমিকরা যাত্রীবাহন চালুর এমন দাবি জানালেও মহামারী পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও ‘কিছু দিন’ এসব গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রাখার কথা বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেছেন, সংক্রমণ আরও কমিয়ে আনার জন্যই এই পদক্ষেপ প্রয়োজন। সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “এখন বাস, ট্রেন, লঞ্চ বন্ধ আছে। আমরা প্রস্তাব করব এটাকে বন্ধ রাখতে।”
সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এক বছর পর গত ৬ই এপ্রিল পুনরায় ‘কঠোর লকডাউন’ এর বিধি-নিষেধ আরোপ করে সরকার। তখন থেকেই বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল। চলমান সেই বিধি-নিষেধের মেয়াদ ২৩শে মে পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। এরপরও দূরপাল্লার গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকবে কি না- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে জাহিদ মালেক বলেন, “এটা ২৩শে মে’র পরেও কি না, সেই সিদ্ধান্ত আমরা এখনই নিতে পারছি না। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ থাকবে আরও বেশ কিছু দিন সময় বন্ধ রাখার।”
শুধু তাই নয়, দ্রুত সংক্রমণশীল করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন ঠেকাতে দেশটির সঙ্গে সীমান্তও আরও কিছু দিন বন্ধ রাখার সুপারিশ করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশ কিছুটা হলেও নিরাপদে আছে। বর্ডার এখন বন্ধ আছে। আগামীতেও বন্ধ থাকবে, এটা আমাদের সুপারিশ থাকবে। যে পর্যন্ত ভারতের অবস্থা মোটামুটি স্বাভাবিক না হয়।”
ভারতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ায় গত ২৫শে এপ্রিল স্থল সীমান্ত পথ বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ সরকার। বিমান ও ট্রেন চলাচল আগে থেকে বন্ধ রয়েছে। ভারতের পরিস্থিতি তুলে ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ভারতে সরকারি হিসাবেই দৈনিক চার হাজারের বেশি লোক মারা যাচ্ছেন। আক্রান্ত হচ্ছেন সাড়ে তিন থেকে চার লাখ মানুষ। এতো কড়াকড়ির মধ্যেও করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআর জানিয়েছে, ভারত থেকে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের নমুনা পরীক্ষা করে এ পর্যন্ত ছয়জনের দেহে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ভারতীয় ধরনটি পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে একজন মারা গেছেন।
এরইমধ্যে চলমান ‘কঠোর লকডাউন’ আরো সাতদিন অর্থাৎ আগামী ২৩শে মে পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। তবে সবশেষ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, অন্য অনেক ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও ট্রেন ও লঞ্চ এবং আন্তঃজেলা বাস আগের মতই বন্ধ থাকবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে জেলার ভেতরে গণপরিবহন চলাচল করতে পারবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে কঠোর বিধিনিষেধের দ্বিতীয় ধাপে ১৪ এপ্রিল থেকে দেশে জরুরি কাজ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যাকে সরকার থেকে বলা হচ্ছে ‘সর্বাত্মক’ বা ‘কঠোর’ লকডাউন।
প্রসঙ্গত, এমন সব বিধিনিষেধের মধ্যে উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানাকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ চালানোর অনুমতি দেওয়া হলেও জরুরি সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ আছে। সরকারের রাজস্ব আদায়ের সাথে সম্পৃক্ত সকল দপ্তর ও সংস্থাও ‘জরুরি পরিষেবার’ আওতাভুক্ত হবে বলে রোববারের প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।
শুরুতে লকডাউনে শপিংমলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও ‘জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনা করে’ গত ২৫শে এপ্রিল থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান ও শপিংমল খোলার অনুমতি দেওয়া হয়।
রোববারের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁ কেবল খাদ্য বিক্রি বা সরবরাহ (টেকওয়ে বা অনলাইন) করতে পারবে।
লকডাউন বাড়ানোর কারণ জানালেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন শনিবার বলেছেন, “লোকজন ঢাকা ছেড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে গেছে তাদের বাড়ি থেকেও ফিরতে অন্তত ১০ দিন লাগবে। সংক্রমণের কী অবস্থা দাঁড়ায় বোঝা যাচ্ছে না। এ জন্য মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
ঈদযাত্রার সঙ্গে যেন ভাইরাস যেন আরও ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য গত ১৩ই থেকে ১৫ই মে ঈদের ছুটিতে সবাইকে কর্মস্থলের এলাকায় থাকতে বলেছিল সরকার। কিন্তু সরকারের এমন নিষেধ না মেনে ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই লাখো মানুষ যে যেভাবে পারেন সেভাবে গ্রামের বাড়ি গেছেন। ঈদযাত্রার এসব মানুষ ছোট ছোট যানবাহনে গাদাগাদি করে সে সময় বাড়িতে গেছে। ফেরিতেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই ছিল না কোথাও। ভিড়ের চাপে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরিতে প্রাণহানিও ঘটেছে।
স্বাস্থ্যবিধি না মেনে এভাবে ভ্রমণ, বিভিন্ন বিপণিবিতানে মানুষের ভিড়ের কারণে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। ঝুঁকি নিয়ে সেই ঈদযাত্রা ঠেকানো না গেলেও এখন মানুষের ফিরতি যাত্রা বিলম্বিত করা যায় কীভাবে, সেই পথ খোঁজার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম।
গণপরিবহন চালু চান শ্রমিকরা
সারাদেশে গণপরিবহন চালুর দাবিতে ঈদের দিনও রাজধানীসহ সারাদেশে বিক্ষোভ করেছেন আন্তঃজেলা ও সিটি বাস টার্মিনালের শ্রমিকরা। অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে শ্রমিকরা প্ল্যাকার্ডে লিখে জানান- ‘পেটে ভাত নাই, গাড়ি চালাতে চাই’, ‘মালিক-শ্রমিকদের ৫ দফা দাবি মানতে হবে’।
শুধু ঢাকাতে নয়, ঈদের দিন বগুড়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলাতেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শ্রমিকরা।
সায়েদাবাদে শ্রমিক নেতা মো. আলী সুবা বলেন, ‘‘আমরা করোনা মহামারীতে আতঙ্ক। তবে আমাদের পেটে পাথর বেঁধে সেই আতঙ্ক দূর হবে না বরং আমরা মরে যাবো। লকডাউনে প্রাইভেট কার, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ সব কিছুই চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মহানগরগুলোতে গণপরিবহনও চলছে। শপিং মলগুলো খোলা। তাহলে দূরপাল্লার পরিবহন কী দোষ করল? আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই গাড়ি চালাতে চাই। এই দাবি আমাদের জীবনের বাঁচা-মরার দাবি।”
পরিবহন শ্রমিকরা অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দুর্দিনে দিন কাটাচ্ছেন বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
শ্রমিকদের পাঁচ দাবির মধ্যে আছে, দূরপাল্লার গণপরিবহন খুলে দেয়া, কর্মহীন সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের আর্থিন অনুদান ও খাদ্য সহায়তা প্রদান, সারাদেশে ট্রাক ও বাস টার্মিনালগুলোতে পরিবহন শ্রমিকদের জন্য ওএমএসে চাল বিক্রি প্রভৃতি।
মালিকরা চাইছেন ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা
ঈদে ঘরমুখো মানুষদের জন্য অর্ধেক যাত্রী নিয়ে দূরপাল্লার গণপরিবহন চালুর পাশাপাশি শ্রমিকদের অনুদান-বেতন-বোনাস ও যানবাহন মেরামতের জন্য সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা চেয়েছেন মালিকরা।
শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়। সেখানে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও সাংসদ শাজাহান খান।
এসব দাবি মানা না হলে সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা ঈদের নামাজ শেষে নিজ এলাকার বাস ও ট্রাক টার্মিনালে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
শাজাহান খান বলেন, শিমুলিয়ার ঘাটে শনিবার এই ফেরিতে উঠা বেপরোয়া মানুষের ঢেউ সামলাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তাই ফেরি চালানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও গাদাগাদি করে এই যাত্রীদের পার করতে বাধ্য হয়।শিমুলিয়ার ঘাটে শনিবার এই ফেরিতে উঠা বেপরোয়া মানুষের ঢেউ সামলাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তাই ফেরি চালানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও গাদাগাদি করে এই যাত্রীদের পার করতে বাধ্য হয়।
শাজাহান খান বলেন, মালিক-শ্রমিক নেতারাও বিশেষজ্ঞ। তাদের বক্তব্য না শুনে পরিবহন চলাচল নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। যদি ফেরির অবস্থা দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন, মানুষ যেভাবেই হোক বাড়ি যেতে চায়। আমাদের বিশেষজ্ঞরা মানুষের কথা বুঝতে চান না।”
করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার রোধে চলমান লকডাউনের মধ্যে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকলেও জেলার ভেতরে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
মহামারী মোকাবেলার স্বার্থে এবারের ঈদে বাড়ি না গিয়ে যে যেখানে আছেন ধৈর্য ধরে সেখানেই থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তারপরও পদ্মা পার হয়ে দক্ষিণের জেলাগুলোতে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ছোট যানবাহন, এমনকি পণ্যের ট্রাক বা পিকআপে চড়েও অনেকে ঢাকা থেকে ভেঙে ভেঙে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়ার ঘাটে যাচ্ছে।
যাত্রীর চাপে শুক্রবার ফেরিতে পরিবহন বন্ধ রেখে গাদাগাদি করে শুধু মানুষ পার করা হয়। পরিস্থিতি সামলাতেই শনিবার থেকে দিনে ফেরি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপরও মানুষ সকালে হাজার হাজার মানুষ গিয়ে ঘাটে ভিড় করেছে।
রাতের বেলায় লুকিয়ে বাস চালানোর অভিযোগের জবাবে শাজাহান খান বলেন, এ বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এটা ঠেকানো পুলিশ ও প্রশাসনের দায়িত্ব।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, প্রায় ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিকের মধ্যে মাত্র দুই থেকে আড়াই লাখ শ্রমিক সরকারের অনুদান হিসেবে আড়াই হাজার করে টাকা পেয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাংসদ মশিউর রহমান রাঙ্গা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ ও জেনারেল সেক্রেটারি আবু রায়হান এসময় সেখানে ছিলেন ।
সংবাদ সম্মেলনে গণপরিবহন ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগের বিপরীতে ঋণের সুদ মওকুফসহ কিস্তি আগামী ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিতকরণ ও ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিয়ে ক্লাসিফাইড ঋণ আনক্লাসিফাইড করার দাবিও তোলা হয়।