|| সারাবেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম ||
তিস্তা নদীর একটি শাখা বুড়িতিস্তা। এটি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার থেতরাই ও দলদলিয়া ইউনিয়নের অর্জুন এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে চিলমারী উপজেলার কাচকল এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলেছে। একসময় বুড়িতিস্তা নদীকে ঘিরে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল। সেই সঙ্গে তিস্তা পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকার নির্ভর করতো বুড়িতিস্তা নদীতে মাছ শিকারের ওপর।
১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের গোড়াইপিয়ারে নির্মিত স্লুইস গেটটি বিলীন হয়ে যায় তিস্তা নদীতে। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ দেয় বুড়িতিস্তার উৎস মুখে। অপরিকল্পিত এই বাঁধের কারনে বন্ধ হয়ে যায় বুড়িতিস্তার স্বাভাবিক পানি প্রবাহ। দখল আর দূষণে মরা খালে পরিণত হয় প্রমত্তা বুড়িতিস্তা।
এই বুড়িতিস্তা রক্ষায় গত ৪ বছর আগে আন্দোলন শুরু করেন উলিপুর প্রেসক্লাব এবং রেল, নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি। তারা নদী খনন করে এর পানির প্রবাহ সৃষ্টি করা ও নদী দখলদারদের উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ২০১৭ সালের ১৩ই মার্চ বুড়িতিস্তা নদী রক্ষায় মানববন্ধন, ২১শে মার্চ বাইসাইকেল র্যালি ও ১১ই এপ্রিল বুড়িতিস্তা পাড়ে হাজারো মানুষ প্রতীকী পানির ঢল কর্মসূচি পালনসহ সভা-সমাবেশ করেন।
উলিপুরের মানুষের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর ডেলটা প্ল্যান কর্মসূচির আওতায় খনন করা হয় ৮০ ফুট প্রস্থ বিশেষে বুড়িতিস্তার ৩১ কিলোমিটার এলাকা। এতে খরচ হয় ১৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
দেশের ৬৪ জেলার ছোট ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় পুনঃখনন (১ম পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুড়িগ্রামের বাস্তবায়নে গত ২ বছর আগের ১৩ই মার্চ উলিপুর উপজেলাধীন বুড়িতিস্তা খাল পুনঃখনন কাজের উদ্বোধন করেন কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক এমএ মতিন। যা ওই বছরেই শেষ হয়। পরিকল্পনা ছিল খনন কাজ শেষে নদীর পানিপ্রবাহ বহমান করতে নদীর উৎসমুখে রেগুলেটর স্থাপন, পাম্পহাউস নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমেও পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা।
নদীর দুপাশে ইরি-বোরো চাষাবাদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পানি প্রবাহ নিশ্চিত, বুড়িতিস্তা নদীর দুই পাড় সংস্কার করে বসার জায়গাসহ সৌন্দর্যবর্ধন ও বিভিন্ন প্রকার ফলদ গাছ রোপণ করা হবে। প্রাণ ফিরে পাবে মরা বুড়িতিস্তা। আবারও পানির ঢল নামবে মরা বুড়িতিস্তায়, বাড়বে ফসল উৎপাদন, জেলেরা ফিরে পাবেন নিজ পেশা। এমন সব স্বপ্ন দেখেছিল নদীর দু’পাড়ের মানুষ।
সরিজমিনে থেতরাই, দলদলিয়া, ধামশ্রেণী, কাচকল ও উলিপুর পৌর এলাকার বুড়িতিস্তা পাড় ঘুরে দেখা গেছে বুড়িতিস্তা খাল পুনঃখনন হলেও দুই বছরে থেতরাই, দলদলিয়া ও ধামশ্রেণী ইউনিয়নে কিছু এলাকায় দায়সারাভাবে পাড় সংস্কার করা হয়েছে।
নদীর দুই পাড় সংস্কার না করা, বিভিন্ন জায়গায় নদীর পাড়ের অংশ কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করা, পাড়ের মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া এমন নানা প্রতিবন্ধকতায় নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ না থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে সংকটে পড়েছে বুড়িতিস্তার নাব্য।
পুন:খননের মধ্য দিয়ে যেখানে নদী থাকার কথা ভরা পানিতে। থাকার কথা জেলেদের মাছ ধরবার নৌকা। কিন্তু সেখানে দেখা যাচ্ছে নদীতে গরু ছাগল ভেড়া চড়াচ্ছেন নদীর দুপাড়ের স্থানীয়রা। শুকনো নদীর দুই পাড়ে পড়ে আছে জেলেদের মাছ ধরার জালের বাঁশের কামান।
রেল, নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির উলিপুর শাখার সভাপতি আপন আলমগীর বলেন, আমাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল থেতরাই থেকে কাচকল পর্যন্ত বুড়িতিস্তা নদীতে পানির ঢল থাকবে। পানির ঢল আনতে নদীতে যে জমিগুলো খনন করা হয়েছে, অধিগ্রহণ সাপেক্ষে তা খালে পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা খাল চাইনি, পূর্ণাঙ্গ নদী চেয়েছি যা অতীতে ছিল। এখন নদীর যে অবস্থা, এটা আমাদের কাম্য নয়। বরং এভাবে নদী খননে অনেক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুড়িতিস্তার স্বাভাবিক পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
তিস্তা নদী রক্ষা কমিটির কুড়িগ্রাম সভাপতি ও উলিপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরদারও নদীর পানিপ্রবাহ বহমান করতে নদীর উৎসমুখে দ্রুত স্লুইসগেট নির্মাণ করে নদীর দুই পাড় সংস্কার করে পুনঃখননের দাবি জানান।
বুড়িতিস্তা বাঁচাও উলিপুর বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, তিস্তা নদী রক্ষা কমিটি কুড়িগ্রাম জেলা শাখার প্রধান উপদেষ্টা ও উলিপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবু সাঈদ সরকার জানান, সরকারের এই উন্নয়নমূলক কাজকে সফল করতে বুড়িতিস্তা নদীর বিভিন্ন এলাকায় অধিগ্রহণে যেসব আইনি জটিলতা রয়েছে, তা অতিদ্রুত নিরসন করে বুড়িতিস্তার স্বাভাবিক পানি প্রবাহে সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, বুড়িতিস্তা নদীর উৎসমুখে রেগুলেটর স্থাপনের প্রস্তাবনা দেয়া আছে, তা পাস হলে স্থাপন করা হবে। তবে বুড়িতিস্তা নদীর বিভিন্ন এলাকায় অধিগ্রহণে আইনি জটিলতা থাকায় হাইকোর্টে মামলা বিচারাধীন তাই নদীর দুই পাড় সংস্কারসহ অন্যান্য কোন কাজের পদক্ষেপ নেয়া যাচ্ছে না।