|| সারাবেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম ||
‘আপনাদের সাংবাদিকদের এখানে আসার দরকার নাই। আমাদের মহব্বত করার দরকার নাই। আপনারা চলে যান, মন্ত্রী, এমপি থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমরা পাও ধরেছি তারা কোন সাড়া দেয় নাই। এখন আপনারা আসছেন দু:খ দুর্দশা তুলে ধরতে। তার দরকার নাই। তুলে ধরে কি হবে। আমরাতো ভাঙনে সর্বশান্ত হয়ে গেছি। আপনারা চলে যান।’—এভাবেই নিজেদের ক্ষুব্ধ প্রকাশ জানালেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বজরা ও গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কাসিমবাজার লকিয়ারপাড় এলাকার ভাঙন কবলিতরা।
সোমবার ৩১শে মে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাসিমবাজার এলাকার তিস্তা নদীর ভাঙনের সরাসরি চিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর সাংবাদিকরা ওই এলাকায় দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে গেলে এমন পরিস্থিতির মধ্যে পরতে হয় গণমাধ্যম কর্মীদের।
স্থানীয় আব্বাস মিয়া (৪৫), হারু মিস্ত্রি (৫২) ও দুলাল দোকানদার জানান, গত তিন বছর থেকে এখানে নদী ভাঙছে। এখন পর্যন্ত প্রায় সহস্রাধিক মানুষ এই নদীর ভাঙনে গৃহহীন হয়েছে। এছাড়াও গত ৪/৫ দিনে প্রায় ৬০টি বাড়ি ভেঙ্গে গেছে। এখনো লোকজন নদীর পাড় থেকে গাছপালা, বাড়ীঘর সরাচ্ছে। কিন্তু কর্তপক্ষের কেউই এখানও দুর্দশার চিত্র দেখতে আসেনি। মোবাইল করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে গৃহহীন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার ১লা জুন সকালে সরজমিন ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায় প্রায় ১৫/১৬টি ভাঙন কবলিত পরিবার খোলা আকাশের নীচে ছাপড়া তুলে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করছে। রাতে বৃষ্টিতে লেজেগোবরে অবস্থা অন্যদের। প্রশাসন থেকে এখনও কেউ খোঁজ নিতে আসেনি।
কাসিমবাজার নাজিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আলতাফ হোসেন রিটায়ারমেন্টের প্রায় ১৫/১৬ লাখ টাকা দিয়ে পাকাবাড়ি নির্মান করেছিলেন, শেষ বয়সে একটু ভালভাবে থাকার জন্য। সেই ভবনটি এখন তিস্তা নদীর পেটে। ভিটেহারা হয়ে এখন তিনি উলিপুরের তবকপুর ইউনিয়নে মেয়ে জামাইয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন।
ওই বাজারের একমাত্র মুচি পরিবার হরিদাস বসতবাড়ী হারিয়ে রাস্তার ঢালে আশ্রয় নিয়েছেন। একই অবস্থা আব্দুল আউয়াল মাস্টারের বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাক ও ছোট ভাই রফিকের। তারা এখন নিঃস্ব হয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের বসতবাড়ী, গাছপালা, আবাদি জমি সব এখন তিস্তা নদীতে মিশে গেছে।
কাসিমবাজার এলাকার গণমাধ্যম কর্মী ফরহাদ হোসেন জানান, গতরাতে (সোমবার) বাড়ি ভেঙে রঞ্জুকারি, সাজু বেকারি এখনো জায়গা পাননি। একই অবস্থা ৩৫/৪০টি পরিবারের। তারা বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গবাদিপশু ও জিনিসপত্র রেখে এসে এখন আশ্রয়ের জায়গা খুঁজছেন। কেউ কেউ করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া হাইস্কুল ও মাদ্রাসার ঘরে আশ্রয়ের জন্য দেনদরবার করছেন। ভিটেমাটি, গাছপালা, জায়গা-জমি হারিয়ে এরা দিশেহারা হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেগা প্রকল্পের নামে এখানে স্বল্পমেয়াদে কাজ করায় তিস্তার তীব্র ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর শত শত পরিবার নতুনভাবে গৃহহীন হচ্ছে। প্রশাসনের লোকজন আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
এই মূহুর্তে তিস্তা নদী ভাঙনে হুমকিতে পড়েছে কাসিমবাজার হাট, নাজিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাসিমবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কাসিমবাজার আলিয়া কামিল মাদ্রাসাসহ সহস্রাধিক বাড়িঘর।
বিষয়টি নিয়ে বজরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবুল আমিন জানান, আমার ইউনিয়ন এবং গাইবান্ধার হরিপুর ইউনিয়নের সীমানায় তিস্তা নদী প্রবলভাবে ভাঙছে। দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না গেলে এলাকাবাসী ব্যাপক ক্ষতির মুখে পরবে।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, বৃষ্টি ও উজান থেকে পানি আসায় তিস্তা নদীতে পানি বাড়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেছি। আগামি সপ্তাহের মধ্যে ভাঙন ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।