অনিয়ম আর হয়রানিতে অভিযুক্ত নাঙ্গলকোট সাব রেজিস্ট্রার অফিস

নতুন একজন দলিল লেখক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি এক বছরে ৩’শ দলিল লিখেছি। সে হিসাবে আমিও অফিস সহকারীর কাছে ৫’শ টাকা করে চাঁদা জমা দিয়েছি। বর্তমান দলিল লেখক সমিতি আমার কাছ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে এক টাকাও দেওয়া হয়নি।

|| সারাবেলা প্রতিনিধি নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা ||

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের একমাত্র সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে গত ১ বছরে প্রায় ১৩ হাজার বিভিন্ন প্রকারের দলিল রেজিষ্ট্রি হয়েছে। এতে প্রতিদিন গড়ে ৮০-৯০টি দলিল রেজিষ্ট্রি হয়।

অভিযোগ উঠেছে, প্রতিদিন রেজিষ্ট্রি করা প্রত্যেক দলিলে অফিস সহকারীর কাছে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা জমা দিতে হয়। দলিল লেখকগণ সারাদিন রেজিষ্ট্রি কার্যক্রম শেষ করার পর বিকেল বেলায় অফিস সহকারী ফিরোজ আলমের কাছে প্রত্যেক দলিল বাবদ এ টাকা জমা দেন। উক্ত টাকার মধ্য থেকে দলিল লেখক সমিতির চাঁদা বাবদ প্রত্যেক দলিল থেকে ৫’শ টাকা হারে এক মাসে যত দলিল রেজিষ্ট্রি হয়, সে মোতাবেক প্রতি মাসে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা সমিতির সভাপতি সোলেমান, সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন ও ক্যাশিয়ার (২ এর পাতায় দেখুন) আবু বকর ছিদ্দিক মাসের শেষ দিন তাদের নামে নাঙ্গলকোট কৃষি ব্যাংকে জমা করেন।

পরবর্তীতে প্রতি ঈদুল ফিতরে ৪০ হাজার টাকা ও ঈদুল আযহায় ৫০ হাজার টাকা করে সমিতির ৭২ জন সদস্য ভাগ ভাটোয়ারা করে নেন। যে সকল দলিল লেখকের সনদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হয়নি, তাদেরকে এক টাকাও দেওয়া হয় না।

নতুন একজন দলিল লেখক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি এক বছরে ৩’শ দলিল লিখেছি। সে হিসাবে আমিও অফিস সহকারীর কাছে ৫’শ টাকা করে চাঁদা জমা দিয়েছি। বর্তমান দলিল লেখক সমিতি আমার কাছ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে এক টাকাও দেওয়া হয়নি। এ রকম ভুক্তভোগী দলিল লেখকের সংখ্যা ৪৫ জন। যাদেরকে তোলা টাকার কোন ভাগ দেওয়া হয়নি।

এতো গেলো দলিল লেখকদের বিরুদ্ধে নয়ছয়ের অভিযোগ। এছাড়া নানা অজুহাতে দলিল রেজিষ্ট্রির জন্য আবেদন করা ফাইল আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে খোদ সাব রেজিষ্টারের বিরুদ্ধে। পরে প্রতি আবেদনে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে দলিল রেজিষ্ট্রি করেন তিনি।

অথছ সাব-কবলা দলিল ব্যাংক পে-অর্ডার করার পর কোন প্রকার টাকা-পয়সা অফিসে জমা দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু নিয়মের প্রতি কোন প্রকার তোয়াক্কা না করেই অফিসে ২৫০০ টাকা দিতে হয়। বর্তমানে এ প্রথা ওপেন সিক্রেট।

এ প্রসঙ্গে কয়েকজন দলিল লেখক অভিযোগ করেন, আমরা একটি দলিল লিখে এক থেকে দুই হাজার টাকা পাই। কিন্তু অফিস প্রতি দলিল ২৫০০ টাকা নিয়ে যায়। এতে এক টাকা কম দেওয়ারও সুযোগ নেই। একটি হেবা ঘোষণা দলিলে ২’শত টাকার স্ট্যাম্প ও ২ টাকার হলফনামা দিয়ে লিখলেও হয়। যার মূল্য কম্পিউটারের খরচসহ সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা। সেই হিসাবে একজন দলিল লেখক তার পারিশ্রমিক ১ হাজার টাকা নিলে সর্বমোট ২ হাজার টাকা খরচ হওয়ার কথা।

বিষয়টি নিয়ে একজন দলিল লেখকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, একটি হেবা ঘোষণা দলিল নিবন্ধন করতে কমপক্ষে সাত থেকে আট হাজার টাকা দিতে হয়। কেন, কী কারণে এই টাকা দিতে হয় সে প্রশ্নের উত্তর জানাতে ওই দলিল লেখক বলেন, আমার খরচ ও অফিসের খরচ মিলিয়ে ৫ হাজার টাকা সর্বমোট খরচ হয়। সে কারণে আমরা সাত থেকে আট হাজার টাকা নিয়ে থাকি। দলিল লেখক সমিতি ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা আবেদনকারীদের কাছ থেকে নেন। ১ লাখ টাকা দলিলের মূল্য হলে সরকারি খরচ মাত্র ৬৫০০ টাকা।

দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সোলেমান ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে সইমুরী নকল বাবদ প্রতি নকলে ১০০ টাকা, প্রতি সাফ কবলা ও অন্যান্য দলিলে ৫০০ টাকা করে এক বছরে জনগণের প্রায় ৫ কোটি টাকা ও সাব রেজিষ্ট্রি এবং অফিস সহকারী মিলিয়ে ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা নিজেদের পকেটে পুরছেনর বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে নাঙ্গলকোট কৃষি ব্যাংক একাউন্ট যাচাই করলে দলিল লেখক সমিতি কর্তৃক নেয়া টাকার হিসাব জানা যাবে বলে অনেক ভুক্তভোগি জানিয়েছেন।

ভুক্তভোগী কয়েকজন দলিল গ্রহীতার সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, তাদের সমিতিকে এসব টাকা কেন কী কারণে দিতে হবে তার কোন সদুত্তর নেই। কয়েকজন ভুক্তভোগী দুর্নীতির বিষয়টি দুদক কার্যালয়ে অভিযোগ করবেন বলেও জানান। এছাড়া ব্যাংক কর্তৃক সম্পাদিত একটি বন্ধকী দলিলে দলিল লেখক সমিতির চাঁদা ১০০০ টাকা এবং সহকারী দিতে হয় ৫০০০ টাকা। একজন বন্ধকী দলিল দাতার সাথে আলাপ করলে তিনি বলেন, আমি ঘুষ বাবদ ছয় হাজার টাকা দিয়েছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌর সদরের একজন দলিল লেকক ও পৌর সদরের বাইরের একজন প্রবীণ দলিল লেখক বলেন, ‘দলিল লেখক সমিতির সদস্যরা অফিসে টাকা কম দেয় এবং আমাদের থেকে বেশি টাকা আদায় করে। কিন্তু তারা সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। আমাদেরকে নিরীহ ভেবে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত জমাকৃত টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে নাঙ্গলকোট দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সোলেমান বলেন, ‘আমরা নিজেরা টাকা জমিয়ে প্রয়োজন মতো ভাগ ভাটোয়ারা করে নেই। কিন্তু কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাত করার অভিযোগটি সঠিক নয়।

নাঙ্গলকোট সাব রেজিষ্টার আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, ‘আমাদের এখানে কাউকে কোন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় না। চলমান লকডাউনে অফিসের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও সত্য নয়’।

সংবাদ সারাদিন